বিশ্বের সেরা ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে জানার ইচ্ছা আমাদের সকলেরই কমবেশী থাকে। তাই বিশ্বের সেরা ব্যক্তিত্বদের জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে বিদ্যাঘরে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন আর্টিকেল লেখা হয়। আজকে আমরা হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনচরিত সম্পর্কে সংক্ষেপে জানব।
আরবের অবস্থা
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের সময় আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ জঘন্য। আরবের লোকেরা ছিল নানা পাপে লিপ্ত। মারামারি, ঝগড়া-বিবাদ, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুন্ঠন, দুর্নীতি ও অরাজকতা করে তাদের জীবন চলত। আল্লাহর পরিবর্তে বিভিন্ন দেব দেবীর পূজা করত। সমগ্র আরবদেশ বর্বরতা ও প্রকৃতি পূজায় নিমজ্জিত ছিল। হাটে বাজারে পণ্যের মত মানুষ বেচাকেনা হত। এদের মনিবরা এদের প্রতি অমানুষিক নির্যাতন চালাত। ব্যাতিক্রম ছাড়া সাধারণভাবে নারীদের অবস্থা ছিল খুবই করুণ। নারীদের কোন সামাজিক মর্যাদা বা অধিকার ছিল না। এমনকি সে সময়ে জীবন্ত মেয়ে শিশুদের গর্তে ফেলে মাটিচাপা দেওয়া হত।এরূপ অবস্থায় আল্লাহ তা’আলা মানুষকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (সা:) কে পাঠান। তার আগে পৃথিবীতে আরো অনেক নবী-রাসূল এসেছেন।আমাদের নবী সর্বশেষ নবী, সকল নবীর সেরা নবী, বিশ্বনবী।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্ম ও পরিচয়
আমাদের প্রিয়নবী ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার মক্কায় জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। মাতৃগর্ভে থাকতেই তার পিতা আব্দুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। জন্মগ্রহণের পর তার নাম রাখা হয় মোহাম্মদ ও আহমদ।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
আরবের বনু সাদ গোত্রের মেয়ে ধাত্রী হালিমার উপর শিশু মুহাম্মদের লালনপালনের দায়িত্ব পড়ে। তিনি ৫ বছর বয়স পর্যন্ত তাকে নিজের সন্তানের মত লালন-পালন করেন। তারপর মুহাম্মদ (সাঃ) মা আমিনার কোলে ফিরে আসেন। তিনি মা আমিনার সীমাহীন আদরে বড় হতে লাগলেন। কিন্তু তার কপালে এ আদরও বেশিদিন জুটল না। তার মাও মৃত্যুবরণ করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৬ বৎসর। অল্প বয়সে তিনি পিতা-মাতা উভয়কে হারিয়ে ইয়াতিম হয়ে যান। বিশ্বের বুকে তিনি তখন একা নিঃসঙ্গ ও অসহায় বালক। উম্মে আয়মান নামক একজন পরিচারিকা তাকে দাদা আবদুল মুত্তালিব এর হাতে তুলে দেন। দাদা অত্যন্ত আদর-যত্নে তাকে লালন পালন করতে থাকেন। তার বয়স যখন ৮ বছর তখন দাদাও তাকে ছেড়ে পরলোকগমন করেন।
এবার তিনি চাচা আবু তালিবের হাতে বড় হতে থাকেন। চাচার সংসারে ছিল অভাব-অনটন। তিনি চাচার ব্যবসায়িক কাজে সহযোগিতা করতেন ও মেষ চরাতেন। চারিত্রিক সকল ভাল গুণ তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। তিনি অহংকার, অপব্যয়, অর্থহীন ও অনৈতিক কথা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতেন। তিনি অন্যের দোষ খোঁজা ও কাউকে লজ্জা দেওয়া থেকেও বিরত থাকতেঁন। সর্বদা মানুষের সাথে হাসিখুশি কথা বলতেন। অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হতেন। মানবতার কল্যাণে নিজের সম্পদ অকাতরে ব্যয় করতেন।তিনি ছিলেন সত্যবাদী। তাকে আপন পর সকলেই আলামিন (বিশ্বাসী) উপাধিতে ভূষিত করেন। এক কথায় তিনি পৃথিবীর সকল প্রাণী ও জীবজন্তুর উপকারী বন্ধু ছিলেন।
পাদ্রি বুহাইরার ভবিষ্যৎবাণী
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বয়স যখন ১২ বছর তখন চাচা আবু তালিবের সাথে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া রওনা হলেন। তিনি বসরায় পৌছলে বুহাইরা (জারজিস) নামক একজন খ্রিস্টান পাদ্রীর সাথে দেখা হয়। তিনি মুহাম্মদ সাঃ কে চিনতে পেরে বলেন তিনি শেষ জামানার নবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। পাদ্রি আবু তালিবকে বলেন, ওকে মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দেন ইহুদিরা তার ক্ষতি করতে পারে। এই পরামর্শ অনুযায়ী চাচা আবু তালিব কয়েকজন ভৃত্যের সঙ্গে প্রিয় ভাতিজা কে মক্কায় পাঠিয়ে দেন।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)
ওকাজ মেলায় জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে ফিজার যুদ্ধ শুরু হয়। একটানা ৫ বছর চলতে থাকে। অনেক লোকের প্রাণহানি ঘটে।মহানবী এসব হানাহানি অবস্থা দেখে কিভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। অবশেষে তিনি শান্তিকামী কয়েকজন যুবককে নিয়ে হিলফুল ফুজুল নামে একটি শান্তি সংঘ গঠন করেন। এর মাধ্যমে তিনি তৎকালীন আরবের চলমান হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি ও হানাহানি বন্ধ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তার এ প্রচেষ্টার ফলে সমাজে কিছুটা শান্তি ফিরে আসে। সকল মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও গোত্রে গোত্রে সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়।
কাবাঘরে কালো পাথর বসানো নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়ার সৃষ্টি হল। তাই গোত্রসমূহের মধ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হলো। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো আগামী দিন সবার আগে যিনি কাবা ঘরে প্রবেশ করবেন তার সিদ্ধান্ত সকলেই মেনে নেব। সকালবেলা দেখা গেল হযরত মুহাম্মদ (সা:) সবার আগে কাবা ঘরে প্রবেশ করেছেন। এটা দেখে সকলেই আনন্দ প্রকাশ করল। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একখানা চাদর বিছিয়ে নিজ হাতে পাথরটি চাদরের মাঝখানে রাখলেন। তারপর সকল গোত্রের সরদার কে ডেকে চাদর ধরতে বললেন। তারা সকলে মিলে চাদরটি বহন করে যথাস্থানে নিয়ে গেল।হযরত মুহাম্মদ (সা:) নিজ হাতে পাথর থানা কাবার দেয়ালে বসিয়ে দিলেন। ফলে জাতি একটি ভয়াবহ যুদ্ধ হতে বেঁচে গেল এবং সকলে পাথরটি বহনের সম্মান পেয়ে খুশি হলেন।
হিলফুল ফুজুলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
১ মজলুম ও অসহায়দের সাহায্য করা
২ সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা
৩ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মৈত্রী ও প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করা
৪ পথিক ও মুসাফিরের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
৫ কোনো জালেমকে মক্কায় প্রবেশ করতে না দেয়া
৬ দুষ্কৃতকারীদের অন্যায় আগ্রাসন প্রতিরোধ করা
৭ অত্যাচারিতকে অত্যাচারির হাত থেকে রক্ষা করা
ততকালীন আরবে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এই সংঘঠনের ভূমিকা ছিল অসামান্য।
নবুয়ত প্রাপ্তি
হযরত মুহাম্মদ সাঃ শৈশবকাল হতেই মানুষের মুক্তি ও শান্তির কথা ভাবতেন। যুবক বয়সে তার এ ভাবনা আরো গভীর হতে থাকে। হযরত খাদিজা (রাঃ) এর সাথে বিবাহের পর তিনি সাধনা ও ধ্যান আরো বাড়িয়ে দেন। তিনি মক্কার অদূরে হেরাগুহায় গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। তিনি সর্বদা চিন্তা করতেন কিভাবে মানব জাতিকে মূর্তিপূজা, অগ্নিপূজা ও শিরক হতে মুক্ত করবেন।এক আল্লাহর পথে নিয়ে আসবেন। এভাবে তিনি হেরাগুহায় একটানা ১৫ বছর ধ্যানে মগ্ন থাকেন। অবশেষে ৪০ বছর বয়সে ৬১০ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র রমজান মাসের ২৭ তারিখ নবুওয়াত লাভ করেন।
নবুয়ত প্রাপ্তির পরের জীবন
নবুওয়াত লাভের পর তিনি লোকদের এক আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দেন। মক্কার কাফেররা তাতে বাধা দেয়। তাই তিনি গোপনে ইসলামের পথে দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যান। আরবের প্রভাবশালী মহল সব সময় তার কাজের বিরোধিতা করতে থাকে। তারা হযরত মুহাম্মদ (সা:) ও তার অনুসারীদের নানাভাবে নির্যাতন করতে থাকে। হযরত মুহাম্মদ (সা:) অত্যান্ত ধৈর্য সহকারে তাদের অত্যাচার সহ্য করেন। নীরবে এক আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের প্রতি মানুষকে আহবান করতে থাকেন। হযরত মুহাম্মদ সাঃ আরব সমাজে কুসংস্কার দূর করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
তথ্য সূত্রঃ