ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ ভাষার ক্ষেত্রে খুবই গরুত্বপূর্ন বিষয়। গত পর্বে আমরা বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ন নিয়ম নিয়ে আলোচনা করব। নিচে সেই সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
উপসর্গের মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
উপসর্গের হাইফেন বসে না। যেমন : উপ-সচিব নয় উপসচিব হবে। অ যদি নাবোধক হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাহলে সেই শব্দের শেষে হীন যুক্ত হয় না। যেমন : অসচেতনহীনভাবে, অক্লান্তিহীনভাবে। অশুদ্ধবাক্যঃ ফুল দিয়ে তাঁকে সুস্বাগতম জানানো সবার কর্তব্য। শুদ্ধবাক্যঃ ফুল দিয়ে তাঁকে স্বাগতম জানানো সবার কর্তব্য। অশুদ্ধবাক্যঃ পাতি লেবুর রস খুব মজা।শুদ্ধবাক্যঃ পাতিলেবুর রস খুব মজা।
চিহ্নের মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
- সংস্কৃতিতে বিশেষণ ও বিশেষ্য দুটিকেই চিহ্নের আওতায় আনা হয়। যেমন: নর – সুন্দর বালক আর নারী – সুন্দরী বালিকা কিন্তু বাংলাতে বিশেষণকে ঠিক রেখে শুধু বিশেষ্যকে নর বা নারী প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ বাংলায় বিশেষণকে নারী বাচক করার দরকার হয় না। যেমন : সুন্দর বালক ও সুন্দর বালিকা।
- সংস্কৃতিতে দুটি বিশেষ্যকেই চিহ্নের আওতায় আনা হয়। যেমন : মেয়েটি পাগলি, আসমা অস্থিরা কিন্তু বাংলাতে দুটি বিশেষ্যের একটিকে নারীচিহ্নের আওতায় আনা হয়। যেমন : মেয়েটি পাগল, আসমা অস্থির ইত্যাদি।
- সংস্কৃতিতে ঈ বা ইনি বা নী প্রত্যয়ই একসঙ্গে বসে কিন্তু বাংলায় বসে না। যেমন : অভাগা – অভাগী/ অভাগিনী, ননদ – ননদী/ ননদিনী। তবে ক্লীববাচক শব্দে নী প্রত্যয় যুক্ত করে নারী বাচক শব্দ তৈরি করতে হয়। যেমন : মেধাবিনী, দুখিনী, যোগিনী, মায়াবিনী ইত্যাদি।
অশুদ্ধবাক্য: রহিমা খুব সুন্দরী। শুদ্ধবাক্য : রহিমা খুব সুন্দর।অশুদ্ধবাক্য : যে মেয়েটি বুদ্ধিমান তাকে দিয়ে কাজটি করিয়ে নাও।শুদ্ধবাক্য : যে মেয়েটি বুদ্ধিমতী তাকে দিয়ে কাজটি করিয়ে নাও।
কারকের মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
বস্তু ও প্রাণিবাচক শব্দে ‘কে’ বসে না। ব্যক্তির নামের সঙ্গেও ‘কে’ বসে না।অশুদ্ধবাক্য : সাপুড়ে সাপকে খেলায়। শুদ্ধবাক্য : সাপুড়ে সাপ খেলায়। অশুদ্ধবাক্য : পাহাড়কে নাড়ায় সাধ্য কার। শুদ্ধবাক্য : পাহাড় নাড়ায় সাধ্য কার। অশুদ্ধবাক্য : রবীন্দ্রনাথকে ভালো করে পড়। শুদ্ধবাক্য : রবীন্দ্রনাথ ভালো করে পড়।
বিপরীত শব্দের মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
সরাসরি ‘না’ শব্দটি ব্যবহার না করে বিপরীত শব্দ ব্যবহার করে বাক্যের গুণ বাড়ানো যায়। সব শব্দের পূর্বে উপসর্গ যোগে বিপরীত শব্দ গঠন করা যায় না। অনেকেই “অ” যোগে বিপরীত শব্দ তৈরি করে থাকেন। যেমন : সফলতা – অসফলতা, মূর্খ – অমূর্খ, ভালো – অভালো। সুন্দর বাক্যঃ দুদিন ধরে ছেলেটির কোনো খোঁজ নাই। আরো সুন্দর বাক্যঃ দুদিন ধরে ছেলেটি নিখোঁজ।
সমোচ্চরিত শব্দের মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
উচ্চারণের দিক থেকে এক হলেও অর্থের দিক থেকে ভিন্ন। বাক্যের অর্থ ঠিক রাখতে সমার্থক শব্দের সঠিক ব্যবহার জরুরি। অশুদ্ধবাক্যঃ তাড়া আমরাতলায় বসে আমরা খাওয়ার সময় মালির তারা খেয়েছে। শুদ্ধ বাক্যঃ তারা আমড়াতলায় বসে আমড়া খাওয়ার সময় মালির তাড়া খেয়েছে।
বাক্যের মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
বিভিন্ন নিয়ম অর্থাৎ সন্ধি, সমাস, উপসর্গ, প্রত্যয় ইত্যাদি দিয়ে শব্দ বানানো যায়। কিন্তু এই বানানো শব্দ পাশাপাশি বসালেই বাক্য হয় না। কিছু গঠন অনুসরণ করেই একটি সার্থক বাক্য তৈরি করা যায়। সার্থক বাক্যের গুণ রক্ষা করে বাক্য বানাতে হয়। বাক্যের অর্থ ঠিক না থাকলে বাক্য গুণহীন হয়ে যায়। আবার যতির ভুল ব্যবহারের কারণেও বাক্যের অর্থের হেরফের হরে যায়।
অশুদ্ধবাক্যঃ পরবর্তীতে আপনি আসবেন। শুদ্ধবাক্যঃ পরবর্তীকালে / পরবর্তী সময়ে আপনি আসবেন। অশুদ্ধবাক্যঃ সেখানে গেলে তুমি অপমান হবে। শুদ্ধবাক্যঃ সেখানে গেলে তুমি অপমানিত হবে। অশুদ্ধবাক্যঃ সূর্য উদয় হয়নি।শুদ্ধবাক্যঃ সূর্য উদিত হয়নি।
বাচ্যের মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
বাচ্যের ক্রিয়াপদের রূপের দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। ইংরেজি Passive Voice-এ ক্রিয়া সবসময় Past Participle হয়। বাংলায় ক্রিয়ার + ইত / ষ্ট ইত্যাদি যোগ করে ক্রিয়াকে কর্মবাচ্যের ক্রিয়া করা হয়। অশুদ্ধবাক্যঃ আপনার কি মনে হয় না, বিধি লঙ্ঘন হয়েছে। শুদ্ধবাক্যঃ আপনার কি মনে হয় না, বিধি লঙ্ঘিত হয়েছে।
এককথায় প্রকাশ, প্রবাদ ও বাগধারার মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
একটি বাক্য শুদ্ধ করতে সম্পূর্ণবাক্য ও এককথায় আনা যাবে না। যেমন ‘হাতে কলমে শিক্ষা বা ব্যবহারিক শিক্ষা যেকোনো একটি বাক্যে ব্যবহার করলে বাক্যটি শুদ্ধ হবে। যদিও একটি বাক্য সুন্দর করতে এককথায় প্রকাশ ব্যবহার
করা দরকার। প্রবাদ ও বাগধারায় যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয় বা হয়েছে শুধু সেসব শব্দ ব্যবহার করতে হবে। সেটি পরিবর্তন করে বাক্য তৈরি করলে বাক্যটি হবে অশুদ্ধ। অশুদ্ধবাক্যঃ পারলে চারদিকে প্রদক্ষিণ কর। শুদ্ধবাক্যঃ পারলে চারদিকে ঘোরো।/পারলে প্রদক্ষিণ কর। অশুদ্ধবাক্যঃ স্বল্প বিদ্যা ভয়ংকরী। শুদ্ধবাক্যঃ অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী। অশুদ্ধবাক্যঃ পরীক্ষায় নকল করাও নদী চুরি। শুদ্ধবাক্যঃ পরীক্ষায় নকল করাও পুকুর চুরি।
যতির মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
আবেগবাচক শব্দের পরে বিস্ময়চিহ্ন বসে শেষে দাঁড়ি বসে। বাক্যে আবেগ, বিস্ময়, ঘৃণা ইত্যাদি উল্লেখ থাকলে বিস্ময়চিহ্ন না বসে দাঁড়ি বসে। অনেকগুলো বিশেষ্য বা সর্বনাম বা বিশেষণ বা ক্রিয়া থাকলে সবগুলোর আগে কমা বসে আর শেষটির আগে “ও বসে অথবা “ও না বসে শেষে ‘ইত্যাদি/প্রভূতি/প্রমুখ’ বসে। ব্যক্তি হলে ‘প্রমুখ’ বসে। একক বা জোড়া যোজক বাক্যে কমা বা সেমিকোলন বসে না। যেমন : একক যোজক : আর, ও, এবং, আবার, তাই, সুতরাং, অতএব, অধিকন্তু, যদি, হয়ত, যথা, সহসা, হঠাৎ, বরং, আপাতত, বস্তুত, মোটকথা, যেহেতু, নইলে, যদি, যদিও, কিন্তু, বা, অর্থাৎ, নতুবা, তথাপি, কিংবা, কিবা, না হয়, নয়ত। জোড়া যোজক : যে-সে, যারা—তারা, যিনি—তিনি, যেসব-তাদের, যারা- তারা, যখন-তখন, যেমন—তেমনি, যদি-তবু, এ-যে-সেটি, এ-সেটি, শুধু-ও। তারিখের বেলায় সংখ্যা পাশাপাশি বসলে কমা বসে কিন্তু তারিখের মাঝে মাসের নাম থাকলে কমা বসে না। উক্তিজাতীয় বাক্যে ‘বলল’র পরে কমা বা ড্যাশ (হাইফেন নয়) বা কোলন বসে তবে বলল’র পরে আরেকটি কমা বলে বললে’র পরে ড্যাশ ব্যবহার করা উচিত। কমার পরে এক বা জোড় ঊর্ধ্বকমা ব্যবহার করার দরকার নাই। কবিতার লাইনে যত্রতত্র যতির ব্যবহার কাম্য নয়। অশুদ্ধবাক্যঃ হায় কী কষ্ট! /হায়, কি কষ্ট! শদ্ধবাক্যঃ হায়! কী কষ্ট। অশুদ্ধবাক্যঃ হাসান তুমি কি তাকে চেনো? শুদ্ধবাক্য : হাসান, তুমি কি তাকে চেনো?