প্রমিত উচ্চারণে কথা বলা এবং শুদ্ধভাবে লেখা দুটোই সৃজনশীল কাজ। এর জন্য অনুশীলন বা নিয়মিত চর্চার প্রয়োজন। এই শুদ্ধ বলা এবং লেখা নির্ভর করে ব্যাকরণের উপর। কেননা ব্যাকরণ ভাষাকে যেমন সুন্দর ও মার্জিত করে তেমনি ভাষায় আনে শৃঙ্খলা। ব্যাকরণের সাহায্য নিয়েই আমরা ভাষায় অপপ্রয়োগ চিহ্নিত করতে পারি এবং শুদ্ধ প্রয়োগ সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারি। শুদ্ধ বলা ও লেখার জন্য ভাষা ও ব্যাকরণের সবকটি বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। শিক্ষার্থীরা যদি মাতৃভাষা বাংলাকে গভীরভাবে ভালবাসে এবং এ বিষয়ে আন্তরিক হয় তাহলে শুদ্ধ বলা ও লেখা অবশ্যই সম্ভব। তাছাড়া প্রতিযোগিতামূলক চাকরির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধপ্রয়োগ থেকে প্রায় বিভিন্ন প্রশ্ন এসে থাকে। তাই বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।
শব্দের মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
সংস্কৃত সহিত থেকে সঙ্গে বা সাথে এর উৎপত্তি। নিয়ম আছে গদ্যে ‘সাথে’ আর পদ্যে ‘সঙ্গে’ ব্যবহার করতে হবে। তবে এখন সর্বত্রই সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি ভুল। আবার বিশেষণ সাধারনত পদক্রম অনুসারে বিশেষ্যের আগে বসে। যেমনঃ খাঁটি গরুর দুধ। এই বাক্যটি ভুল। কারণ খাঁটি দুধ বলতে গরুর দুধ কেই বুঝানো হয়। আলাদাভাবে আবার গরু শব্দটি ব্যবহার অনুচিত। এমন নানা ভুল শব্দ আমরা ভাষায় প্রয়োগ করে থাকি।
অশুদ্ধ বাক্যঃ রহিম ছেলেদের মধ্যে কনিষ্ঠতম /তর।
শুদ্ধ বাক্যঃ রহিম ছেলেদের মধ্যে কনিষ্ঠ।
অশুদ্ধ বাক্যঃ আপনি সদা সর্বদা জনগণের মঙ্গল চেয়েছেন।
শুদ্ধ বাক্যঃ আপনি সর্বদা জনগণের মঙ্গল চেয়েছেন।
অশুদ্ধ বাক্যঃ আপনার তো খুব সৃজনশীল ক্ষমতা।
শুদ্ধ বাক্যঃ আপনার তো খুব সৃজন ক্ষমতা।
সংখ্যার মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
গুরুত্বপূর্ণ দিবসের ক্ষেত্রে সংখ্যাবাচক শব্দটি কথায় লিখতে হবে। যেমনঃ পহেলা বৈশাখ, ছাব্বিশে মার্চ, একুশে ফেব্রুয়ারি। বর্তমানে কথায় না লিখে অর্ধেক অংকে আর অর্ধেক কথায় লেখা হচ্ছে। তাই কেউ সংখ্যার শেষে ই/ল/শ দেয় আবার কেউ দেয় না। যেমনঃ ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর। এছাড়া ৪র্থ, ৫মী, ৭মী লিখে থাকেন। এগুলো ভুল।
অশুদ্ধ বাক্যঃ এবার ৫ম শ্রেণী থেকে সমাপনী পরীক্ষা শুরু হল।
শুদ্ধ বাক্যঃ এবার পঞ্চম শ্রেণী থেকে সমাপনী পরীক্ষা শুরু হল।
অশুদ্ধ বাক্যঃ ১লা জুলাই ভোট অনুষ্ঠিত হবে।
শুদ্ধ বাক্যঃ পহেলা জুলাই ভোট অনুষ্ঠিত হবে।
বচনের মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ , শুদ্ধ প্রয়োগ
অনেকেই একটি বাক্যে দুবার বা তিনবার বহু চিহ্ন ব্যবহার করে থাকে যা বাক্যের গুণ নষ্ট করে। যেমনঃ গ্রামগুলো সব, লক্ষ লক্ষ শিশুগুলো, সব রাজাকারদের, সকল যুদ্ধাপরাধীদের ইত্যাদি। কিছু শব্দটি ব্যবহার হলে এরপরে বহুবচন হয় না। যেমনঃ কিছু লোকদের। বচন ঘাটতি বা বাহুল্যের কারণেও বচন ভুল হতে পারে। যেমনঃ
অশুদ্ধ বাক্যঃ লক্ষ লক্ষ জনতা সব উপস্থিত হয়েছিল।
শুদ্ধ বাক্যঃ লক্ষ লক্ষ জনতা উপস্থিত হয়েছিল।
অশুদ্ধ বাক্যঃ সব পাখিরা ঘর বাঁধে না।
শুদ্ধ বাক্যঃ সব পাখি ঘর বাঁধে না।
অশুদ্ধ বাক্যঃ যেসব ছাত্রদের নিয়ে কথা তারা বখাটে।
শুদ্ধ বাক্যঃ যেসব ছাত্রকে নিয়ে কথা তারা বখাটে।
নির্দেশকের মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
টা/টি/খানা/খানি ব্যবহার করে শব্দকে নির্দিষ্ট করলে তার আগে ‘এই’ বা ‘ঐ’ ব্যবহার করা যাবে না। আবার গুলো বা গুলি বা গুলিন থেকে শুধু গুলো ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া নির্দেশক ‘টি’ র ব্যবহার বেশি করা যেতে পারে।
অশুদ্ধ বাক্যঃ ঐ লোকটি খুব সৎ।
শুদ্ধ বাক্যঃ লোকটি খুব সৎ।
অশুদ্ধ বাক্যঃ এই ছেলেটি কার?
শুদ্ধ বাক্যঃ এই ছেলে কার?
অশুদ্ধ বাক্যঃ এই বইখানি দাও।
শুদ্ধ বাক্যঃ বইখানি দাও।
সন্ধির মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
আমরা জানি সংস্কৃত ও সংস্কৃত শব্দে সন্ধি করতে হয়। সংস্কৃত ও বাংলা শব্দের সন্ধি হয় না। বাংলা ও বাংলা শব্দের সন্ধি না করে আলাদা লেখাই ভালো।
অশুদ্ধ বাক্যঃ ব্যাপারটি ছিল আপনার জন্য লজ্জাস্কর।
শুদ্ধ বাক্যঃ ব্যাপারটি ছিল আপনার জন্য লজ্জা কর।
অশুদ্ধ বাক্যঃ ইত্যাবসারে বৃদ্ধ লোকটির দিন কাটে।
শুদ্ধ বাক্যঃ ইত্যবসারে বৃদ্ধ লোকটির দিন কাটে।
অশুদ্ধ বাক্যঃ উল্লেখিত বিষয় হল তিনি একজন সমাজসেবী।
শুদ্ধ বাক্যঃ উল্লিখিত বিষয় হল তিনি একজন সমাজসেবী।
সমাসের মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ এবং শুদ্ধ প্রয়োগ
সমাসবদ্ধ শব্দ হলে এক শব্দে লিখতে হবে। অথবা হাইফেন দিতে হবে। ‘ও’ দিয়ে দুটি শব্দ যুক্ত হলে শব্দ দুটি ‘এ’ বিভক্তি যুক্ত হতে হবে। সহ অর্থ বুঝালে স্ব না বসে স বসে। সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে সংস্কৃত শব্দের সমাস হয়। সমাস জাত শব্দ ও ব্যাসবাক্য একইসঙ্গে বসে না। সমাসবদ্ধ শব্দের বানানে শুধু মাঝের ‘ঈ’ কার ‘ই’ কার হয়।
অশুদ্ধ বাক্যঃ বন ও জঙ্গলে এখন আর বাঘ থাকে না।
শুদ্ধ বাক্যঃ বনে জঙ্গলে এখন আর বাঘ থাকে না।
অশুদ্ধ বাক্যঃ তিনি স্বসম্মানে হল ত্যাগ করলেন।
শুদ্ধ বাক্যঃ তিনি সসম্মানে হল ত্যাগ করলেন।
অশুদ্ধ বাক্যঃ আমাদের দেশ নদীমাতা দেশ।
শুদ্ধ বাক্যঃ আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ।
বিভক্তির মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
একই পদে দুটি বিভক্তি বসে না। তবুও ব্যবহার করা হয়। ‘কে’ একাধিক কারকে ব্যবহৃত হয় বলে একে তির্যক বিভক্তি বলে। তবে যে কারকেই ব্যবহৃত হোক না কেন সেটি হতে হবে একবচনে। বহুবচন জাতীয় শব্দে ‘কে’ বসে না। যেমনঃ তাদেরকে দিয়ে এ কাজ করিও না। সব পাগল গুলোকে দিয়ে ক্লাস নেয়। এক শব্দে দুটি বিভক্তি বসলে শব্দের গুন হারায়। যেমনঃ তোমার কথায় বুকেতে আঘাত পাই। গেলাসে করে দুধ দাও। বস্তু বাচক একবচন পদে কোন বিভক্তি বসে না। যেমনঃ ঘড়িকে হাতে দাও। বইকে পুড়িয়ে ফেল।
অশুদ্ধ বাক্যঃ ভিক্ষুকদেরকে ভিক্ষা দাও।
শুদ্ধ বাক্যঃ ভিক্ষুককে ভিক্ষা দাও।
অশুদ্ধ বাক্যঃ আপনারা কেন ভাল মানুষগুলোকে মারলেন।
শুদ্ধ বাক্যঃ আপনারা কেন ভাল মানুষগুলো মারলেন।
অশুদ্ধ বাক্যঃ এই কলমটিকে দিয়ে ভালো লেখা হয়।
শুদ্ধ বাক্যঃ কলমটি দিয়ে ভালো লেখা হয়
প্রত্যয়ের মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ শুদ্ধ প্রয়োগ
কোন শব্দের সঙ্গে কোন প্রত্যয় যুক্ত হয় তা খেয়াল রেখেই শব্দ তৈরি করতে হয়। তাই প্রত্যয় ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হয়। একই শব্দের সঙ্গে দুটি প্রত্যয় চিহ্ন বসে না।
অশুদ্ধ বাক্যঃ টিউশন করে সে গাড়ি বাড়ি করেছে।
শুদ্ধ বাক্যঃ টিউশনি করে সে গাড়ি বাড়ি করেছে।
অশুদ্ধ বাক্যঃ বিকার লোক যে কোন সময় ক্ষতি করতে পারে।
শুদ্ধ বাক্যঃ বিকৃত লোক যেকোনো সময় ক্ষতি করতে পারে
পক্ষের মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ শুদ্ধ প্রয়োগ
প্রথমপক্ষ যদি অন্য পক্ষের সঙ্গে একই বাক্যে ব্যবহৃত হয় তাহলে ক্রিয়া প্রথম পক্ষ অনুসারে হয়। এক শেষ হলে নিয়ম অনুসারে প্রথমে সে, তুমি ও আমি বসে আর ক্রিয়া প্রথম পক্ষ অনুসারে হয়।
অশুদ্ধ বাক্যঃ আমি অর্থাৎ হাসান জেনেশুনে ভুল করি না।
শুদ্ধ বাক্যঃ আমি অর্থাৎ হাসান জেনেশুনে ভুল করে না।
অশুদ্ধ বাক্যঃ আমি, সে আর তুমি কাজটি করব।
শুদ্ধ বাক্যঃ সে, তুমি আর আমি কাজটি করব।
শব্দদ্বিত্বের মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
বিভিন্ন প্রকার বা পদ দুবার ব্যবহার করে শব্দ বানাতে পারি। কিন্তু অর্থের দিকে খেয়াল করতে হয়। যেমনঃ ফলাফল শব্দটি ঠিক ব্যবহার কিন্তু এর প্রতিশব্দ হিসেবে লেখা হয় ফলশ্রুতিতে তাহলে শব্দটি হবে ভুল। কারণ ফলশ্রুতি অর্থ শ্রবণ কোন বিষয়ের ফল নয়। ভাষাভাষী অর্থাৎ কোন একটি ভাষা ব্যবহারকারী। তাই ভাষাভাষীর পূর্বে কোন ভাষার নাম উল্লেখ করে লিখলে তা হবে ভুল। যেমনঃ বাংলা ভাষাভাষী।
অশুদ্ধ বাক্যঃ ঘাম জলে তার শার্ট ভিজে গেছে।
শুদ্ধ বাক্যঃ ঘামে তার শার্ট ভিজে গেছে।
অশুদ্ধ বাক্যঃ অশ্রু জলে তার কপাল ভিজে গেছে।
শুদ্ধ বাক্যঃ অশ্রুতে তার কপাল ভিজে গেছে।
অশুদ্ধ বাক্যঃ ঘরটি ছিমছিমে অন্ধকার।
শুদ্ধ বাক্যঃ ঘরটি ঘুটঘুটে অন্ধকার।