শুরুতে গণিতের ধারণাগুলো আমাদের মস্তিষ্কে সৃষ্টি হয় তুলনা করার মাধ্যমে। দুটি বস্তুর মাঝে কোনটি ছোট বা বড়, কম বা বেশী, কাছে বা দূরে ইত্যাদি। এর পরেই আমরা এই সকল তুলনাকে নিখুতভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি এবং একই ধরনের কোন বস্তু কয়টা আছে তা দেখে দেখে আলাদা ভাবে গুণতে শিখে যাই। গণনায় ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দকেই আমরা সংখ্যা বা (Number) বলে থাকি। এ সকল সংখ্যাকে এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ …. এভাবে নাম করণ করে থাকি। এ সংখ্যা গুলোকে অনুভব করতে, বাস্তবে আমরা একই রকম বিভিন্ন পরিমাণ কোন কিছুকে চোখে দেখে থাকি। তাই এই সকল সংখ্যাকে আমরা ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক সংখ্যা বলে থাকি।
এই সংখ্যাগুলোকে যখন আমরা লিখতে চাই তখন প্রয়োজন হয় বিভিন্ন চিহ্নের। এই চিহ্ন বা প্রতীক গুলোকেই অঙ্ক (Digit) বলে। সংখ্যার পরিমাণ অসীম তাই এই বিশাল সংখ্যাকে প্রকাশ করতে আলাদা আলাদা চিহ্ন বানানো যেমন কঠিন তেমনি মনে রাখাও বেশ দূরহ। তাই প্রয়োজন এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে অল্প সংখ্যক চিহ্ন দিয়ে এই বিশাল সংখ্যাকে প্রকাশ করা যায়। এই পদ্ধতিকেই বলা হয় সংখ্যা পদ্ধতি।
শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সাধারণত আমাদের চার ধরনের সংখ্যা পদ্ধতির সাথে পরিচয় ঘটে। যথাঃ ১. দশমিক ২. দ্বিমিক ৩. অক্টাল এবং ৪. হেক্সাডেসিমাল সংখ্যা পদ্ধতি। এই সংখ্যা পদ্ধতিগুলোর এমন নাম হওয়ার পিছনে খুব সাধারণ একটি লজিক রয়েছে। যেমনঃ – দশমিক, এই পদ্ধতিতে মাত্র দশটি চিহ্ন বা অঙ্ক (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ০) দ্বারা সকল সংখ্যাকে প্রকাশ করা হয় তাই এর নাম দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি। তেমনি দ্বিমিক এ মাত্র দুইটি (১, ০), অক্টালে আটটি (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ০), এবং হেক্সাডেসিমেলে ষোলটি (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, A, B, C, D, E, F, 0) চিহ্ন দ্বারা সকল সংখ্যাকে প্রকাশ করা হয়।
অঙ্কঃ সংখ্যা প্রকাশের জন্য যে সকল চিহ্ন ব্যবহার করা হয় তাদের অঙ্ক বলে। যেমন – দশমিক পদ্ধতিতে ব্যবহৃত (১, ২, ৩, থেকে .. ৯, এবং ০)। এখানে প্রথম (১ …. ৯) পর্যন্ত অঙ্ক গুলোকে স্বার্থক অঙ্ক বলে। শেষের ‘০’ কে শুন্য বা সংখ্যার অভাব জ্ঞাপক অঙ্ক বলে। ‘০’ এককভাবে মানের অস্তিত্বহীনতা প্রকাশ করে। কিন্ত অন্যান্য স্বার্থক অঙ্কের পরে বসে ঐ অঙ্কের স্থানীয় মান প্রকাশ করে (স্থানীয় ও স্বকীয় মান সম্পর্কে অঙ্ক পাতন অংশে আলোচনা করা হয়েছে)। কোন সংখ্যা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত মোট অঙ্কের সংখ্যাকে বলে বেস বা ভিত্তি।
সংখ্যাঃ সংখ্যা দ্বারা কোন নির্দিষ্ট পরিমাণকে বুঝায়। সংখ্যাকে অঙ্কের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। যেমন ১৩ সংখ্যাটিকে দুটি চিহ্ন বা অঙ্ক ১ এবং ৩ দ্বারা বুঝানো হয়েছে।
সংখ্যা পদ্ধতিঃ কোন সংখ্যা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত অঙ্কগুলোর মাধ্যমে সকল সংখ্যাকে প্রকাশ করার পদ্ধতিকে সংখ্যা পদ্ধতি বলে। চার ধরনের সংখ্যা পদ্ধতির মধ্যে দশমিক পদ্ধতিকে সাধারণ হিসাব নিকাশের জন্য ব্যবহার করা হয়। (তাই গণিত শিখার প্রাথমিক অংশে শুধু দশমিক পদ্ধতি নিয়েই আলোচনা করা হবে। অন্যান্য পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে মাধ্যমিক বিজ্ঞানের আই সি টি অংশে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে)
অঙ্ক পাতন
অঙ্ক দ্বারা সংখ্যা লিখার কৌশলকে অঙ্ক পাতন বলে। অঙ্ক পাতন বুঝতে হলে প্রথমে অঙ্কের স্বকীয় ও স্থানীয় মান সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। দশমিক পদ্ধতিতে আমাদের হাতে দশটি অঙ্ক (১, ২, ৩ ….. , ৯, ০) রয়েছে। এই দশটি অঙ্ক দিয়েই আমাদের সকল সংখ্যাকে প্রকাশ করতে হবে। এর মধ্যে আবার ‘০’ প্রতীক বা অঙ্ক দ্বারা কোন মানকে বুঝায় না তাহলে আমরা নয়টি প্রতীক দিয়ে মাত্র নয়টি সংখ্যাকে প্রকাশ করতে পারব। অর্থাৎ এর পরের সংখ্যাগুলো প্রকাশ করতে আমাদের অন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। এই পদ্ধতিই হচ্ছে অঙ্ক পাতন। এখানে প্রথম নয়টি সংখ্যাকে বিদ্যমান নয়টি অঙ্ক দ্বারা প্রকাশ করা হয়, তাই এই নয়টি চিহ্ন বা অঙ্ককে আলাদা ভাবে লিখলেই নয়টি সংখ্যা প্রকাশ করে। যেমন ‘৬’ এই অঙ্কটি দেখলেই বুঝি এখানে ছয়টি সংখ্যা বুঝানো হয়েছে। কোন অঙ্ককে এককভাবে লিখলেই যে মান প্রকাশ পায় তাকে ঐ অঙ্কের স্বকীয় মান বলে।
আমরা ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছি প্রথম নয়টি সংখ্যা প্রকাশের পর অন্য সংখ্যাগুলো প্রকাশ করতে কোন একটি পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। এক্ষেত্রে অঙ্কের অবস্থান পরিবর্তন করতে হয়। এটি করার জন্য আমরা ‘০’ শুন্যকে ব্যবহার করি। এখানে আগেই ০ কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে – ‘০’ এককভাবে মানের অস্তিত্বহীনতা প্রকাশ করে। কিন্ত অন্যান্য স্বার্থক অঙ্কের পরে বসে ঐ অঙ্কের স্থানীয় মান প্রকাশ করে। যেমন ‘১০’ এখানে ‘১’ অঙ্কটির পরে ‘০’ বসায় ‘১’ অঙ্কটির অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে, ডান দিক থেকে হিসাব করলে ‘১’ দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। এ অবস্থায় ‘১’ অঙ্কটির মান পরিবর্তীত হয়েছে। যা নয় এর পরের সংখ্যাকে বুঝায় অর্থাৎ দশ। তাই অঙ্ক পাতনের নিয়মে সংখ্যায় ডান দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানকে দশক বলে। এখন দশ এর একক স্থানে ‘১’ বসিয়ে পাই ‘১১’ এখানে একক স্থানেও ‘১’ এবং দশক স্থানেও ‘১’ কিন্তু অবস্থানের কারণে দুই ‘১’ এর মান ভিন্ন। একক স্থানের মান যে কোন অঙ্কের স্বকীয় মানের সমান হয়। তাই একক স্থানের ‘১’ এর মান এক। কিন্ত দশক স্থানের ‘১’ এর মান দশ। তাহলে ‘১১’ এই সংখ্যার মান হয় দশ + এক = এগারো। আবার একক স্থানে ‘২’ বসলে হয় বার। এভাবে একক স্থানের মান ‘৯’ পর্যন্ত পরিবর্তন করার পর দশক স্থানের ‘১’ এর সাথে আর কোন বিন্যাস বাকি থাকে না। তাই ‘১৯’ এর পরের সংখ্যা বুঝাতে দশক স্থানে অঙ্কের পরিবর্তন করতে হয়। এভাবে অঙ্কগুলোর অবস্থান পরিবর্তন করে অঙ্কের মানের পরিবর্তন ঘটানো হয় এবং ধারাবাহিকভাবে সংখ্যাগুলোকে বুঝানো হয়। এখানে সংখ্যায় ব্যবহৃত অঙ্কগুলোর অবস্থানের কারণে মানের যে পরিবর্তন হয় তাকে অঙ্ক গুলোর স্থানীয় মান বলে। আর এভাবেই স্থানীয় মান ব্যবহার করে অঙ্কগুলোর দ্বারা সংখ্যা লিখার পদ্ধতিকে অঙ্ক পাতন বলে।
স্বকীয় মানঃ কোন সংখ্যা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত অঙ্কগুলোকে একক স্থানে লিখলে যে মান প্রকাশ করে তাকে ঐ অঙ্কের স্বকীয় মান বলে।
স্থানীয় মানঃ কোন সংখ্যায় ব্যবহৃত অঙ্কগুলোর অবস্থানের কারণে যে মান প্রকাশ পায় তাকে ঐ অঙ্কের স্থানীয় মান বলে।
সংখ্যার বিভিন্ন অবস্থানের নাম ও মানঃ সংখ্যায় ডান দিক থেকে প্রথম স্থানকে বলা হয় ‘একক’, এ স্থানে কোন অঙ্কের মান তার স্বকীয় মানের এক গুণ। দ্বিতীয় স্থানকে বলা হয় ‘দশক’, এ স্থানে কোন অঙ্কের মান তার স্বকীয় মানের দশ গুণ। তৃতীয় স্থানকে বলা হয় ‘শতক’ এ স্থানে অঙ্কের মান তার স্বকীয় মানের একশত গুণ। চতুর্থ স্থানকে বলা হয় ‘হাজার’ এ স্থানে অঙ্কের মান তার স্বকীয় মানের এক হাজার গুণ। পঞ্চম স্থানকে বলা হয় ‘অযুত’ এ স্থানে অঙ্কের মান তার স্বকীয় মানের দশ হাজার গুণ। ষষ্ঠ স্থানকে বলা হয় ‘লক্ষ্য’, এ স্থানে কোন অঙ্কের মান তার স্বকীয় মানের এক লক্ষ্য গুণ। সপ্তম স্থানকে বলা হয় ‘নিযুত’ এ স্থানে কোন অঙ্কের মান তার স্বকীয় মানের দশ লক্ষ্য গুণ। অষ্টম স্থানকে বলা হয় ‘কোটি’ এ স্থানে অঙ্কের মান তার স্বকীয় মানের এক কোটি গুণ।
কোটি – নিযুত – লক্ষ্য – অযুত – হাজার – শতক – দশক – একক
উদাহরণঃ ‘৮৫৯৬১৪৩৩’ এ সংখ্যাটির মান হবে
কোটি = ৮ x ১০০০০০০০ = ৮০০০০০০০
নিযুত = ৫ x ১০০০০০০ = ৫০০০০০০
লক্ষ্য = ৯ x ১০০০০০ = ৯০০০০০
অযুত = ৬ x ১০০০০ = ৬০০০০
হাজার = ১ x ১০০০ = ১০০০
শতক = ৪ x ১০০ = ৪০০
দশক = ৩ x ১০ = ৩০
একক = ৩ x ১ = ৩
এখন প্রাপ্ত সকল ফলাফলগুলো যোগ করলে দাঁড়ায় “আট কোটি উনষাট লক্ষ্য একষট্টি হাজার চারশত তেত্রিশ”।
আমরা অংক সবাই কিছু না কিছু শিখি, কিন্তু এতটা বিস্তারিত আলোচনা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও খুব একটা করা হয় না। অংকের প্রাথমিক এই বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে একটি শিক্ষার্থীর শুধু অংক শিখাই হবেনা বরং তাঁর জ্ঞানেরও অনেক বৃদ্ধি পাবে।